সেরগেই এসেনিন বলছে
ইসাডোরা, বার্লিনে তোমার সঙ্গে আছি আমি।
আমার সঙ্গে আরেক কবি – গাধাও বলতে পারো -
গলায় ঝোলানো গিটার,
খামোখাই,
বাজাতে-টাজাতে পারে না।
কোত্থেকে এলেন আমাদের সেই মহাকথাশিল্পী,
ম্যাকসিম গোর্কি।
চেহারা ভাঙাচোরা হলে কী হবে,
চোখ দুটিতে তাঁর যেন ছুরির ঝলক,
সেই চোখ সব-কিছুর অন্তস্তলে ঢুকে যায়।
আমার দিকে তাকিয়ে গোর্কি,
চোখে স্নেহ ঝরে পড়ছে,
বললেন, ‘এসেনিন, কবিতা লিখছ তো?’
আমি পাশের গাধা-কবিটার সঙ্গে
তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলাম।
ছোট্ট একটা ঘরের মধ্যে তুমি নাচছ, ইসাডোরা।
মরচে-রঙা পোশাক তোমার।
তোমার আধ-খোলা স্তনজোড়ার বিভাজিকায়
একগুচ্ছ মলিন ফুলের স্তবক।
নাচছিলে তুমি -
কী-যে বিচ্ছিরি লাগছিল তোমাকে!
গেলাশে চুমুক দিয়ে
তাকাচ্ছিলাম চোখের কোনায়।
তারপর
ক্লান্ত হাঁটু মুড়ে
একটা মাদি-ঘোড়ার মতো
যেন ভেঙে পরলে আমার পায়ের কাছে।
ঠোঁটে অর্থহীন বাঁধানো হাসি নিয়ে
তাকালে আমার দিকে।
আমি তো তোমার ভাষা জানি না।
রিয়াজানের ছেলে আমি।
ইঙ্গিতে,
কনুইয়ের ঠেলায়,
হাঁটুর গুঁতোয়
আমার কথা ঠিকঠাকই জানিয়ে দিচ্ছিলাম তোমাকে।
এখানে যারা আছে তারা কিছু না-বুঝলেও,
গোর্কির তীক্ষ্ম চোখই বলে দিচ্ছিল :
আমি তোমার শরীরের
গোপনতম তিলটিরও খোঁজ রাখি।
আমাকে যখন কবিতা আবৃত্তি করতে বলা হলো,
উঠলাম।
আমার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে
ওঠানামা করছিল আমার হাত।
শ্রোতা-দর্শকদের চোখ-মুখ জানিয়েদিচ্ছিল
তারা কিরকম উদ্দীপিত হয়ে উঠছে।
বিশ্ববিখ্যাত হতে পারো তুমি,
কিন্তু তোমার নৃত্যের ঘূর্ণি-যেঅন্তত আজ,
এখানে,
এই আসরে,
কিছু নয় -
সেটাও আয়নার মতো পরিষ্কার ফুটে উঠছিল
ওদের চোখে।
আর তারপর তুমি
বেহায়ার মতো
সব রুশীদের চুমো খাচ্ছিলে।
মদ-জড়ানো গলায়
বলছিলে তোমার ভাঙা রুশ ভাষায়,
‘আহা, রাশিয়ানরা কত ভাল!
এরকম দেখিনি আর-কোথাও!’
সব বাহানা!
সবাইকেই তুমি বলো ওরকম!
এ তো আমার নিজের চোখে দেখা -
মার্কিনিদের সঙ্গে,
ব্রিটিশদের সঙ্গে,
ফরাশিদের সঙ্গে
একই তোষামুদে ভাষায় কথা বলেছ।
একেবারে একই ভাষায়।
ছিঃ!
রিয়াজানের গ্রামীণ যুবতীরাও তোমার চেয়ে সুন্দর!
*
আমি বেরিয়ে এলাম।
একা।
বার্লিনের পথ-ঘাট কিছু চিনি না।
ঘুরতে ঘুরতে নদীতীরে এলাম।
কে-একজন বলল, এর নাম বুড়িগঙ্গা নদী!
আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
এই নদী থেকে অন্য নদীতে পড়ব -
সেই নদী থেকে আরেক নদীতে -
এম্নি করে পৌছে যাব একদিন
ইছামতী নদীতে।
তারপর সাঁৎরে উঠব পাড়ে।
পৌছে যাব জালালপুর গ্রামে।
আম-জাম-কাঁঠালগাছে সবুজে-সবুজ
আমাদের সেই বাড়িতে গিয়ে উঠব।
সেখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে সবাই।
পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ
পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ ঝর্না থেকে নেমে এসেছিলো।
এখন, রহস্যময় জলে, খেলা করে অবিরল।
পদ্মায় গিয়েছে একটি– মেঘনায়-যমুনায়-সুরমায়–
আর-একটি গোপন ইচ্ছায়। পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ
ঝর্না থেকে নেমে এসে সাঁতরে চলে বিভিন্ন নদীতে।
পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ জলের রহস্য ভেদ করে
এখন একাকী এক শব্দহীন সমুদ্রে চলেছে।
গ্রিনরোড
একদিন কুলিরোড ছিলে।
হাঁটু অব্দি ডোবানো ধুলোয় ছিলে এক নির্জন তাপস।
অড়হরখেতে একদিন দেখেছিলাম তরুণ খরগোশ
যেন কোন প্রাকৃতিক নিবিড় নিখিলে
বিদ্যুচ্চমক তুলে মিশে গিয়েছিলোমটরশুঁটির খেতে।
লাল-কালো কুঁচফল পেড়েছি একদিন সান্দ্র ঝোপ থেকে
দেখেছি ধানখেত, কামময়, গভীর খোড়ল,কৈশোরক নিরুদ্বেগে,
কৌতূহলে। তারপর সপ্তর্ষির
নৈশ
সংকেতে
আমগাছ জামগাছ কাঁঠালগাছের শ্যাম
ক্রমাগত মুছে মুছে উঠে আসছে তরুণবিল্ডিং,
নিভে যাচ্ছে ঘাস, উবে যাচ্ছে নিবিড় বৃষ্টির দিন;
তবু তোমাকে কেন্দ্র রেখে একদিন ঝরেছে যে-পাতার শিকল
ধরিত্রীরই কোনোখানে যে-সব রয়েছেঅবিকল–
অনশ্বর, অবিচ্যুত, স্বপ্নবিদ্ধ, নির্লিপ্ত, সকাম ।
কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড
এখানে কবিতা বানানো হয়।
সব ধরনের কবিতা।
রাজনীতিক কবিতা, সামাজিক কবিতা।
নাগরিক কবিতা, গ্রামীণ কবিতা।
প্রেমের কবিতা, শরীরের কবিতা।
স্বপ্নের কবিতা, বাস্তবের কবিতা।
চল্লিশের কবিতা, পঞ্চাশের কবিতা।
ষাটের কবিতা, সত্তরের কবিতা।
আশির কবিতাও আমরা বাজারে ছাড়ছি শিগগিরই।
কবিতার হাত, পা, মাথা, ধড়,
শিশ্ন, যোনি, চুল, নখ,
চোখ, মুখ, নাক, কান,
হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল–
সব-কিছু মওজুদ আছে আমাদের এখানে।
স্বদেশি ও বিদেশি উপমা ও চিত্রকল্প,
শব্দ ও ছন্দ,
অন্ত্যমিল ও মধ্যমিল
লক্ষ লক্ষ জমা আছে আমাদের স্টকে।
ব্যাঙের ছাতার মতো আরো অনেক কবিতার কোম্পানি
গজিয়েছে বটে আজকাল। কিন্তু,
আপনি তো জানেনই,
আমাদের কোম্পানি ইতোমধ্যেই বেশ নাম করেছে।
আর ফাঁকি দিয়ে কি খ্যাতি অর্জন করা সম্ভব,
বলুন?
হ্যাঁ, আপনার অর্ডার-দেওয়া কবিতাটি এই-তো তৈরি হয়ে এলো।
চমৎকার হয়েছে।
ফিনিশিং টাচ শুধু বাকি।
একটু বসুন স্যার, চা খান,
কবিতার কয়েকটা ইস্ক্রুপ কম পড়ে গেছে আমাদের,
পাশের কারখানা থেকে একছুটে নিয়ে আসবার জন্যে
এখখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি লতিফকে।
আলোক সরকার আর অন্ধকার রায়
‘একি, আপনি বাজারে? কবিশাহেব, আপনিও কি বাজার করেন?’
–হ্যাঁ, আমাকেও বাজার করতে হয়,
আমাকেও তেল-নুন-মাংসের হিশেব কষতে হয়–
আমি নই বায়ুভুক রবীন্দ্রনাথ।
কবিতাকেও হতে হয় পৌরুষেয়–
শুধু নারীলাবণিগ্রস্ত নয়।
বসন্তের সংঘর্ষে জ্বলে উঠতে হয় আগুনের মতো।
জীবনানন্দকেও একদিন খালি গায়ে দুই হাতে দুই ভরা পানির বালতি
বয়ে নিয়ে যেতে দেখেছিলেন
অনুজ কবি আলোক সরকার আর অন্ধকার রায় ।
সৃষ্টিশীলতার প্রতি
শুধু তোমাকে সালাম– আর কাউক্কে তোয়াক্কা করি না,
আর-সব-পায়ে-দলা মুথাঘাস– শুধু তুমি ঘাসে রত্নফুল,
আর-সব নোংরা টাকা-পয়সার মতো : হাতে-হাতে ঘোরে-ফেরে–
শুধু তুমি অমল-ধবল তুমি,
তোমার আহারে শুধু ঘড়ি লাগে– আর-কিছুই রোচে না তোমার,
নামো ঝরনা ফাটিয়ে পাথর– সৃষ্টি তার মুখোশ ছিঁড়েছে,
বস্তুর বিরুদ্ধে শুধু অফুরান প্রজাপতি ওড়ে ।
মালার স্মৃতি
‘মনে রাখার দিন গিয়েছে, এখন ভোলারপালা!’
_প্রশ্ন আমার : ভুলতে কি পেরেছিলেন কাজী কবি স্বয়ং?
বর্ণহীন জীবনে কেউ ভুলতে পারে ভালোবাসার রঙ?
মালার স্মৃতি থেকেই যায়, যতো শুকোক মালা!