আর যদি নাই আসো –
—বিনয়মজুমদার
আর যদি নাই আসো,ফুটন্ত জলের নভোচারী
বাষ্পের সহিত যদি বাতাসের মতো না-ই মেশো,
সেও এক অভিজ্ঞতা ; অগণন কুসুমের দেশে
নীল বা নীলাভবর্ণ গোলাপের অভাবের মতো
তোমার অভাব বুঝি ; কে জানে হয়তো অবশেষে
বিগলিত হতে পারো ; আশ্চর্য দর্শনবহু আছে
নিজের চুলের মৃদু ঘ্রাণের মতন তোমাকেও
হয়তো পাইনা আমি, পূর্ণিমার তিথিতেও দেখি
অস্ফুট লজ্জায় ম্লান ক্ষীণ চন্দ্রকলা উঠে থাকে,
গ্রহণ হবার ফলে, এরূপ দর্শন বহু আছে ।
ফিরে এসো, চাকা-৫৫—বিনয়মজুমদার
হৃদয়, নিঃশব্দে বাজো; তারকা, কুসুম, অঙ্গুরীয়—
এদের কখনো আরো সরব সংগীত শোনাবো না।
বধির স্বস্থানে আছে; অথবা নিজের রূপে ভুলে
প্রেমিকের তৃষ্ণা দ্যাখে, পৃথিবীর বিপণিতে থেকে।
কবিতা লিখেছি কবে, দু-জনে চকিত চেতনায়।
অবশেষে ফুল ঝ’রে, অশ্রু ঝ’রে আছে শুধু সুর।
কবিতা বা গান… ভাবি, পাখিরা— কোকিল গান গায়
নিজের নিষ্কৃতি পেয়ে, পৃথিবীর কথা সে ভাবে না।
ফিরে এসো, চাকা-৩৩ -২৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬২ –
বিনয় মজুমদার
রোমাঞ্চ কি রয়ে গেছে; গ্রামে অন্ধকারে ঘুম ভেঙে
দেহের উপর দিয়ে শীতল সাপের চলা বুঝে
যে-রোমাঞ্চ নেমে এলো, রুদ্ধশ্বাসস্বেদে ভিজে-ভিজে।
সর্পিনী, বোঝনি তুমি, দেহ কিনা, কার দেহ, প্রাণ।
সহসা উদিত হয় সাগরহংসীর শুভ্র গান।
স্বর-সুর এক হয়ে কাঁপে বায়ু, যেন তুষত শীতে,
কেঁদে ওঠে, জ্যোৎস্নার কোমল উত্তাপ পেতে চায়।
রোমাঞ্চ তো রয়ে গেছে শীতল সাপেরস্পর্শে মিশে।
অনেক কিছুই তবু
বিনয় মজুমদার
অনেক কিছুই তবু বিশুদ্ধ গণিত শাস্ত্র নয়
লিখিত বিশ্লিষ্ট রূপ গণিতের অআকখময়
হয় না, সে সব ক্ষেত্রে উপযুক্ত গণিতসূত্রের
নির্যাস দর্শনটুকু প্রয়োগ ক’রেই বিশ্লেষণ
করা একমাত্র পথ, গণিতশাস্ত্রীয় দর্শনের
বহির্ভূত অতিরিক্ত দর্শন সম্ভবপর নয়।
সেহেতু ঈশ্বরী, দ্যাখো গণিতের ইউনিট
পাউন্ড সেকেন্ড ফুট থেমে থাকে চুপে,
এদের নিয়মাবদ্ধ সততা ও অসততা মনস্তত্ত্বে বর্তমান ইউনিট রূপে
আলোকিত ক’রে রাখে বিশ্বের ঘটনাবলী, চিন্তনীয় বিষয়গুলিকে
সিরিজের কতিপয় টার্মের চরিত্র ফুটে চরিত্র নির্দিষ্ট করে
আগামীর দিকে।
একটি গান –
বিনয় মজুমদার
X=0
এবং Y=0
বা X=0=Y
বা X=Y
শূন্য 0 থেকে প্রানী X ও Y সৃষ্টি হলো
এই ভাবে বিশ্ব সৃষতি শুরু হয়েছিলো।
শিমুল গাছের নিচে –
বিনয় মজুমদার
শিমুল গাছের নিচে গম ক্ষেত দেখলাম আজ।
পুরো গম ক্ষেতটিই বাদামি রঙের, তাতে অন্য রঙ নেই
দেখে দেখে মনে হয় ক্ষেতে গম পেকে গেছে প্রায়।
আমিও পথের মাঝে থেমে প’ড়ে গম গাছগুলি দেখলাম।
বুঝলাম ইউরোপে এবং আমেরিকায় শস্যক্ষেতগুলি এ প্রকার।
আমাদের বাঙলায় ধান ক্ষেত সমূহের ধরন যেমন
গমক্ষেত সমূহের ধরন তেমন নয়, স্পষ্টতই বিদেশি ধরন।
এ যেন ইউরোপের কিয়দংশ দেখছি এখানে
শিমুল গাছের নিচে; এইসব ধান গম মানুষের মেধার ফসল
ধান গম খেয়ে খেয়ে মানুষের হৃৎপিন্ড সচল থাকে এ কথা সকলেই জানি।
বর্ষাকালে –
বিনয় মজুমদার
বর্ষাকালে আমাদের পুকুরে শাপলা হয়, শীত গ্রীষ্মে এই
পুকুর সম্পূর্ণ শুশক হয়ে যায় পুকুরের নিচে ঘাস গিজায়,তখন–
পুকুরে শাপলা আর থাকে না, আবার সেই বর্ষাকাল আসে
তখন পুকুরটিতে জল জমে পুনরায় শাপলা গজায়।
এই হলো শাপলার কাহিনী, শাপলা ফুল শাপলার পাতা
ছন্দে ছন্দে দুলে যায়, অনুপ্রাস, চিত্রকল্প ইত্যাদি সমেত।
এবং পুকুরটিও চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল, পুকুরের আনন্দ বেদনা
পাতা হয়ে ফুল হয়ে ফুটে ওঠে পৃথিবীতে, এই বিশ্বলোকে।
শাপলার ফুলে ফুলে পাতায় কখনো মিল থাকে, মিল কখনো থাকে না।
২২ জুন, ১৯৬২-ফিরে এসো,চাকা
– বিনয় মজুমদার
যাক, তবে জ’লে যাক, জলস্তম্ভ, ছেঁড়া ঘা হৃদয়।
সব শান্তি দূরে থাক, সব তৃপ্তি, সব ভুলে যাই।
শুধু তার যন্ত্রণায় ভ’রে থাক হৃদয় শরীর।
তার তরণির মতো দীর্ঘ চোখে ছিলো সাগরের
গভীর আহ্বান, ছায়া, মেঘ, ঝঞ্ঝা, আকাশ, বাতাস।
কাঁটার আঘাতদায়ী কুসুমের স্মৃতির মতন
দীর্ঘস্থায়ী তার চিন্তা; প্রথম মিলনকালে ছেঁড়া
ত্বকের জ্বালার মতো গোপন, মধুর এ-বেদনা।
যাক, সব জ্ব’লে যাক, জলস্তম্ভ, ছেঁড়া ঘা হৃদয়।
করবী তরুতে –
বিনয় মজুমদার
করবী তরুতে সেই আকাঙ্ক্ষিত গোলাপ ফোটে নি ।
এই শোকে ক্ষিপ্ত আমি ; নাকি ভ্রান্তি হয়েছে কোথাও?
অবশ্য অপর কেউ, মনে হয়, মুগ্ধ হয়েছিল,
সন্ধানপর্বেও দীর্ঘ, নির্নিমেষ জ্যোৎস্না দিয়ে গেছে ।
আমার নিদ্রার মাঝে, স্তন্যপান করার মতন
ব্যবহার ক’রে বলেশিহরিত হৃদয়ে জেগেছি ।
হায় রে বাসি না ভালো, তবু এও ধন্যসার্থকতা,
এই অভাবিত শান্তি, মূল্যায়ন, ক্ষিপ্ত শোকে ছায়া ।
তা না হ’লে আস্বাদিত না হবার বেদনায় মদ,
হৃদয় উন্মাদ হয়, মাংসে করে আশ্রয়-সন্ধান ।
অখচ সুদূর এক নারী শুধু মাংস ভোজনের
লোভে কারো কাছে তার চিরন্তন দ্বার খুলেছিলো,
যথাকালে লবণের বিস্বাদ অভাবে ক্লিষ্ট সেও ।
এই পরিনাম কেউ চাই না, হে মুগ্ধ প্রীতিধারা,
গলিত আগ্রহে তাই লবণ অর্থাৎ জ্যোৎস্নাকামী ।
কবিতা বুঝিনি আমি
– বিনয় মজুমদার
কবিতা বুঝিনি আমি ; অন্ধকারে একটি জোনাকি
যত্সামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক ।
এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ প’ড়ে আছে—
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট ক’রে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
তারকা, জোনাকি—সব ; লম্বিত গভীরহয়ে গেলে
না-দেখা গহ্বর যেন অন্ধকার হৃদয় অবধি
পথ ক’রে দিতে পারে ; প্রচেষ্টায় প্রচেষ্টায় ; যেন
অমল আয়ত্তাধীন অবশেষে ক’রে দিতে পারে
অধরা জ্যোত্স্নাকে ; তাকে উদগ্রীব মুষ্টিতে ধ’রে নিয়ে
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের, অন্তরের সার পেতে পারি ।
এই অজ্ঞানতা এই কবিতায়, রক্তে মিশে আছে
মৃদু লবণের মতো, প্রশান্তির আহ্বানের মতো ।
তুমি যেন ফিরে – বিনয় মজুমদার
তুমি যেন ফিরে এসে পুনরায় কুণ্ঠিত শিশুকে
করাঘাত ক’রে ক’রে ঘুম পাড়াবার সাধ ক’রে
আড়ালে যেও না ; আমি এত দিনে চিনেছি কেবল
অপার ক্ষমতাময়ী হাত দুটি, ক্ষিপ্র হাত দুটি—
ক্ষণিক নিস্তারলাভে একা একা ব্যর্থ বারিপাত ।
কবিতা সমাপ্ত হতে দেবে নাকি? সার্থক চক্রের
আশায় শেষের পঙক্তি ভেবে ভেবে নিদ্রা চ’লে গেছে ।
কেবলি কবোষ্ণ চিন্তা, রস এসে চাপ দিতে থাকে ।
তারা যেন কুসুমের অভ্যন্তরে মধুর ঈর্ষিত
স্থান চায়, মালিকায় গাঁথা হয়ে ঘ্রাণ দিতে চায় ।
কবিতা সমাপ্ত হতে দাও, নারী, ক্রমে—ক্রমাগত
ছন্দিত ঘর্ষণে, দ্যাখ, উত্তেজনা শির্ষ লাভ করে,
আমাদের চিন্তাপাত, কসপাত ঘটে, শান্তি নামে ।
আড়ালে যেও না যেন, ঘুম পাড়াবার সাধ ক’রে ।
একটি উজ্জ্বল মাছ
– বিনয় মজুমদার
একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত পস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেলো — এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেগনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হ’লো ফল |
বিপন্ন মরাল ওড়ে, অবিরাম পলায়ন করে,
যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নিচে
রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ ;
স্বল্পায়ু বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত পাহাড়ে পাহাড়ে ;
সমস্ত জলীয় গান বাষ্পিভূত হ’য়ে যায়, তবু
এমন সময়ে তুমি, হে সমুদ্রমত্স্য, তুমি…তুমি…
কিংবা, দ্যাখো, ইতস্তত অসুস্থ বৃক্ষেরা
পৃথিবীর পল্লবিত ব্যাপ্ত বনস্থলী
দীর্ঘ-দীর্ঘ ক্লান্তশ্বাসে আলোড়িত করে ;
তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে
চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা |
সময়ের সাথে এক বাজি ধরে
– বিনয় মজুমদার
সময়ের সাথে এক বাজি ধরে পরাস্ত হয়েছি ।
ব্যর্থ আকাঙ্খায়, স্বপ্নে বৃষ্টি হয়ে মাটিতে যেখানে
একদিন জল জমে, আকাশ বিস্বিত হয়ে আসে
সেখানে সত্বর দেখি ,মশা জন্মে; অমল প্রতূষে
ঘুম ভেঙ্গে দেখা যায় ; আমাদের মুখের ভিতর
স্বাদ ছিল, তৃপ্তি ছিল জে সব আহার্য প’চে
ইতিহাস সৃষ্টি করে; সুখ ক্রমে ব্যথা হয়ে উঠে ।
অঙ্গুরীয় নীল পাথরের বিচ্ছুরিত আলো
অনুষ্ণো অনির্বাণ , জ্বলে যায় পিপাসার বেগে
ভয় হয় একদিন পালকের মত ঝরে যাব ।
মুকুরে প্রতিফলিত
– বিনয় মজুমদার
মুকুরে প্রতিফলিত সূর্যালোক স্বল্পকাল হাসে |
শিক্ষায়তনের কাছে হে নিশ্চল, স্নিগ্ধ দেবদারু
জিহ্বার উপরে দ্রব লবণের মত কণা-কণা
কী ছড়ায়, কে ছড়ায় ; শোনো, কী অস্ফুট স্বর, শোনো
‘কোথায়, কোথায় তুমি, কোথায় তোমার ডানা, শ্বেত পক্ষীমাতা,
এই যে এখানে জন্ম, একি সেই জনশ্রুত নীড় না মৃত্তিকা?
নীড় না মৃত্তিকা পূর্ণ এ অস্বচ্ছ মৃত্যুময় হিমে…’
তুমি বৃক্ষ, জ্ঞানহীন, মরণের ক্লিষ্ট সমাচার
জানো না, এখন তবে স্বর শোনো,অবহিতহও |
সুস্থ মৃত্তিকার চেয়ে সমুদ্রেরাকত বেশি বিপদসংকুল
তারো বেশি বিপদের নীলিমায় প্রক্ষালিত বিভিন্ন আকাশ,
এ-সত্য জেনেও তবু আমরা তো সাগরে আকাশে
সঞ্চারিত হ’তে চাই, চিরকাল হ’তে অভিলাষী,
সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভালো লাগে ব’লে |
তবুও কেন যে আজো, হায় হাসি, হায় দেবদারু,
মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়!
কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে
– বিনয় মজুমদার
কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে সকালে জেগেছি সবিনয়ে।
কৌটার মাংসের মতো সুরক্ষিত তোমার প্রতিভা
উদ্ভাসিত করেছিল ভবিষ্যৎ, দিকচক্রবাল।
সময়ে ভেবেছিলাম সম্মিলিত চায়ের ভাবনা,
বায়ুসেবনের কথা, চিরন্তন শিখরের বায়ু।
দৃষ্টিবিভ্রমের মতো কাল্পনিক বলে মনে হয়
তোমাকে অস্তিত্বহীনা, অথবা হয়তো লুপ্ত, মৃত।
অথবা করেছে ত্যাগ, অবৈধ পুত্রের মতো, পথে।
জীবনের কথা ভাবি, ক্ষত সেরে গেলে পরে ত্বকে
পুনরায় কেশোদ্গম হবে না; বিমর্ষ ভাবনায়
রাত্রির মাছির মতো শান্ত হয়ে রয়েছে বেদনা-
হাসপাতালের থেকে ফেরার সময়কার মনে।
মাঝে মাঝে অগোচরে বালকের ঘুমের ভিতরে
প্রস্রাব করার মতো অস্থানে বেদনা ঝরে যাবে।
সন্তপ্ত কুসুম ফুটে
– বিনয় মজুমদার
সন্তপ্ত কুসুম ফুটে পুনরায় ক্ষোভে ঝরে যায়।
দেখে কবিকুল এত ক্লেশ পায়, অথচ হেতরু,
তুমি নিজে নির্বিকার, এই প্রিয় বেদনা বোঝো না।
কে ক্থোয় নিভে গেছে তার গুপ্ত কাহিনী জানি।
নিজের অন্তর দেখি, কবিতার কোনো পঙক্তি আর
মনে নেই গোধূলিতে; ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই।
অথবা গৃহের থেকে ভুল বহির্গত কোনো শিশু
হারিয়ে গিয়েছে পথে, জানে না সে নিজের ঠিকানা।
চাদেঁর গুহার দিকে
– বিনয় মজুমদার
চাদেঁর গুহার দিকে নির্নিমেষে চেয়ে থাকি, মেঝের উপরে
দাড়িয়েঁ রয়েছে চাঁদ, প্রকাশ্য দিনের বেলা, স্পষ্ট দেখা যায়
চাদেঁর গুহার দিকে নির্নিমেষে চেয়ে থাকি, ঘাসগুল ছোট করে ছাঁটা।
ঘাসের ভিতর দিয়ে দেখা যায় গুহার উপরকার ভাঁজ।
গুহার লুকোনো মুখ থেকে শুরু হয়ে সেই ভাঁজটি এসেছে
বাহিরে পেটের দিকে। চাঁদ হেঁটে এসে যেই বিছানার উপরে দাঁড়াল
অমনি চাঁদকে বলি,’ তেল লাগাবে না আজ’ শুনে চাঁদ বলে
‘মাখব নিশ্চয়, তবে একটু অপেক্ষা কর’ বলে সে অয়েল ক্লথ নিয়ে
পেতে দিল বিছানায়, বালিশের কিছু নিচে, তারপর হেঁটে এসে চলে গেল
নিকটে তাকের দিকে,একটি বোতল থেকেবাম হাতে তেল নিয়ে এল
এসে তেল মাখা হাতে ভুট্টাটি চেপেধরে।
যখন ধরল তার আগেই ভুট্টাটি খাড়া হয়ে গিয়েছিল।
চাঁদ আমি দুজনেই মেঝেতে দাঁড়ানো মুখোমুখি
এক হাতে ঘসে ঘসে ভুট্টার উপরে চাঁদ তেল মেখে দিল।
মুকুট
– বিনয় মজুমদার
এখন পাকুড়গাছে সম্পূর্ণ নূতন পাতা, তার সঙ্গে বিবাহিত এই
বটগাছে লাল লাল ফল ফলে আছে।
চারিদিকে চিরকাল আকাশ থাকার কথা,আছে কিনা আমি দেখে নিই।
অনেক শালিক পাখি আসে রোজ এই গাছে,বট ফলগুলি
তারা খুটেঁ খুটেঁ খায় বসন্তের হাওয়া বয়, শালিকের ডাক
এবং পাতার শব্দ মিশে একাকার হয়ে চারদিকে ভাসে।
এখন অনেক মেঘ সোনালি রূপালি কালোআকাশে আকাশে।
একটি মুকুট সেই পাকুড় গাছের নিচেশাড়ি পরে দাড়িয়েঁ রয়েছে।
মদের ফেনার মতো সাদা সাদা দাঁত আমি অনেক দেখেছি।
জেনেছি আগুন যত্ দুরেই হোক না কেন তাকে দেখা যায়।
মুকুরের বুকে ঠাঁই পেতে হলে সরাসরি সম্মুখেই চলে যেতে হয়
পিছনে বা পাশে নয়; গ্রন্থ ছন্দোবদ্ধ হলে তবে আপনিই মনে থাকে
মৃত্যু অবধিই থাকে; মানুষ সমুদ্রকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসে।
আমার বাড়ির থেকে
– বিনয় মজুমদার
আমার বাড়ির থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখি অগণিত যুবতী চলেছে।
এইসব বিবাহিতা এবং অবিবাহিতা যুবতীদিগের প্রত্যেকের
অন্তরে জয়পতাকা কিভাবে থাকে আমি সু ন্দর নিখুঁতভাবে দেখি
তাকিয়ে তাকিয়ে ওরা যখন হাঁটেঁ বাবসে থাকে।
প্রত্যেকটি যুবতীর অন্তরে জয়পতাকা প্রবেশ করেছে বহুবার,
নিজের অন্তরে ঢোকা জয়পতাকাকে খুব ভালবাসে যে কোনো যুবতী।
অনেক জয়পতাকা অন্তরে প্রবেশ করে তার মধ্যে যে জয়পতাকা
অন্তরে আনন্দ দেয় সবচেয়ে বেশি পরিমাণ
তাকেই বিবাহ করে অনূড়া যুবতীগণ। আমার বাড়ির থেকে বাইরে বেরিয়ে
প্রতিদিন আমি দেখি অগণিত যুবতী চলেছে।
আমার শোবার ঘর ছেড়ে
– বিনয়মজুমদার
আমার শোবার ঘর ছেড়ে আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম।
বারান্দার পাশ দিয়ে একটি মুকুট হেঁটে চলে গেল অতিশয় ধীরে,
আমি মনোযোগ দিয়ে তার বস্তাবৃত অঙ্গ দেখলাম।
এ মুকুট প্রৌঢ়া ফলে মুকুটের ফুল দুটি বেশ ঝুলে পড়েছে নিশ্চয়,
আরো এ বয়সে ফুলে অনেক নখের দাগ নিশ্চয় লেগেছে
মুকুট পরার কালে ফুল টেপবার ফলে, তবুও মুকুট তার ফুল
কৌশলে কাঁচুলি দিয়ে বেঁধেছে এমনভাবে যাতে মনে হয় তার ফুল
মোটেই ঝোলে নি আর বারংবার নিয়মিতমুকুট পরার ফলে নিশ্চয় মুকুট
বেশ বড় হয়ে গেছে এই প্রৌঢ় বয়সে ও যদিও অবিবাহিতা আছে।
আমার আশ্চর্য ফুল
– বিনয় মজুমদার
আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমিষেই
গলাধঃকরণ তাকে না ক’রে ক্রমশ রস নিয়ে
তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে।
অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে
জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল-
আকাশের হৃদয়ের; কাকে বলে নির্বিকার পাখি।
অথবা ফড়িঙ তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়।
উড়ে যায় শ্বাস ফেলে যুবকের প্রানের উপরে।
আমি রোগে মুগ্ধ হয়ে দৃশ্য দেখি, দেখি জানালায়
আকাশের লালা ঝরে বাতাসের আশ্রয়ে আশ্রয়ে।
আমি মুগ্ধ; উড়ে গেছ; ফিরে এসো, ফিরে এসো , চাকা,
রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো।
আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন
সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথীবীর সব আকাশে।
আমরা দুজনে মিলে
– বিনয় মজুমদার
আমরা দুজনে মিলে জিতে গেছি বহুদিন হলো ।
তোমার গায়ের রঙ এখনো আগের মতো , তবে
তুমি আর হিন্দু নেই , খৃষ্টান হয়েছো ।
তুমি আর আমি কিন্তু দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি ।
আমার মাথার চুল যেরকম ছোটো করে ছেঁটেছি এখন
তোমার মাথার চুলও সেইরূপ ছোটো করে ছাঁটা ,
ছবিতে দেখেছি আমি দৈনিক পত্রিকাতেই ; যখন দুজনে
যুবতী ও যুবক ছিলাম
তখন কি জানতাম বুড়ো হয়ে যাব ?
আশা করি বর্তমানে তোমার সন্তান নাতি ইত্যাদি হয়েছে ।
আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে ,
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে ,
চিঠি লিখব না ।
আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায় ।
মানুষ
– বিনয় মজুমদার
দেবভাষার ব্যাকরণ অনুসারে মানুষসৃষ্টি করা হয় । দেবভাষার ব্যাকরণ একখানা ‘সমগ্র ব্যাকরণ কৌমুদী’ । পাঠক দেখুন দেবভাষায় একটি শব্দ নেই ‘মনোলীন’ শব্দটি নেই । শব্দরা সব দেবদেবী । দেবভাষায় মনোলীন শব্দদেবতাটি নেই । এইবার আমি মনোলীন শব্দটি লিখছি । তাহলে ভবিষ্যতে মনোলীন শব্দদেবতাটি সৃষ্টি হবে – দেখতেহবে মানুষের মতো ।
দেবভাষার ব্যাকারণে ‘গদাধর’ শব্দটি আছে । কিনতু ‘গদাধরা’ শব্দটি নেই । তাহলে ‘গদাধরা’ শব্দদেবীটিকে বানানো সম্ভব । গদাধরা শব্দদেবীটির চেহারা মেয়েমানুষের মতো ।
পাখি
– বিনয় মজুমদার
পাঠক মুখ দিয়ে উচ্চারণ করুন ‘নিড়িহা’ । দেখুন মাথার উপর দিয়ে একটি পাখি উড়ে যাচ্ছে । এই নিড়িহা পাখিটি আমি বানিয়েছি । বহুদিন আগে ছাপা হয়ে গেছে । কবি অজয় নাগ মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল ‘দাদা , এমন অদ্ভুত একটি শব্দ বানিয়েছেন? ‘ এতদিন পরে আমি অজয়ের প্রশ্নের জবাব লিখে জানালাম ।
এইবার পাঠক জোরে উচ্চারণ করুন ‘পিড়িহা’ । দেখুন মাথার উপর দিয়ে একটি পাখি উড়ে যাচ্ছে । পাখিটি পাঠক বানালেন ।
এইবার জোরে উচ্চারণ করুন ‘ফিড়িহা’ । পাঠক দেখুন মাথার উপর দিয়ে একটা ল্যাংটো বালক দেখা যাচ্ছে । পাঠক এই বালকটিকে বানালেন ।
এইবার পাঠক জোরে উচ্চারণ করুন ‘বিড়িহা’ । পাঠক দেখুন মাথার উপর দিয়ে শকুনের মতো বিরাট একটি পাখিউড়ে যাচ্ছে ।
সৃষ্টির উপায়
– বিনয় মজুমদার
শব্দ ব্রহ্ম । অর্থাৎ শব্দের আকার আছে । ‘সফেদা’ একটি শব্দ- ধ্বনি । এই শব্দের আকার সফেদা ফলটি যেমনি ঠিক তেমনি । এর শব্দতাতিবক প্রমাণ আছে । ‘আতা’ একটি শব্দ- ধ্বনি । আতা শব্দটির চেহারা ঠিক আতা ফলটির মতো । পাঠকআপনিও এইরকম নতুন শব্দ দিয়ে ধ্বনি দিয়ে নতুন ফল বানাতে পারেন।
একটি নতুন শব্দ- ধ্বনি ‘হিবয়া’ । হিবয়া উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে একটি নতুন ফল দেখা যাচ্ছে ।
ঘুমোবার আগে
– বিনয় মজুমদার
তপ্ত লৌহদণ্ড জল ডোবাতে এবং সেই জল খেত নরনারীগণ,
তার ফলে মানুষের রক্তাল্পতা দুর্বলতা জনিত অসুখ সেরে যেত।
এইভাবে এককালে বাঁচতাম মানুষেরাএই পৃথিবীতে।
তবে সবই ঠিক আছে, ঘুমোবার আগে মনেপড়ে সারা দিনের ঘটনা।
মাঝরাতে বিছানায় চাঁদের জ্যোৎস্না এসে পড়ে দূর থেকে।
শুধু চাঁদ দেখবার জন্য আমি বিছানায় উঠে বসি, চাঁদ আছে বলে
ঘুমোতে বিলম্ব হয়। আমি তাড়াতাড়ি ফের যাব।
কুঁড়ি
– বিনয় মজুমদার
পদ্মপাতার প’রে জল টলমল করে; কাছেকোনো ফুল তো দেখিনা,
সাধ জাগে, – বড়ো সাধ জাগে -
ডুব দিয়ে দেখে আসি নধর জলে নিচে
আকাশের অভিমুখী উন্মুখ কুঁড়ি আছে কিনা।
হয়তো সে কুঁড়ি
ফোটবার ইচ্ছায় থেকে থেকে – থেকে থেকে
কোন কালে হয়ে গেছে বুড়ি;
কোন কালে তার সব রূপ গেছে প’চে;
হয়তো বা তার আর নেই কোন লেশ।
সাধ জাগে, বড়ো সাধ জাগে-
ডুব দিয়ে দেখে আসি নধর জলে নিচে
এখনো রয়েছে কিনা কোন অবশেষ।
২১ জুন ১৯৬১ – ফিরে এসো চাকা
– বিনয় মজুমদার
সময়ের সাথে এক বাজি ধরে পরাস্ত হয়েছি ।
ব্যর্থ আকাঙ্খায়, স্বপ্নে বৃষ্টি হয়ে মাটিতে যেখানে
একদিন জল জমে, আকাশ বিস্বিত হয়ে আসে
সেখানে সত্বর দেখি ,মশা জন্মে; অমল প্রতূষে
ঘুম ভেঙ্গে দেখা যায় ; আমাদের মুখের ভিতর
স্বাদ ছিল, তৃপ্তি ছিল জে সব আহার্য প’চে
ইতিহাস সৃষ্টি করে; সুখ ক্রমে ব্যথা হয়ে উঠে ।
অঙ্গুরীয় নীল পাথরের বিচ্ছুরিত আলো
অনুষ্ণো অনির্বাণ , জ্বলে যায় পিপাসার বেগে
ভয় হয় একদিন পালকের মত ঝরে যাব ।
আমাকে ও মনে রেখো
– বিনয় মজুমদার
পৃথিবী,সূর্য ও চাঁদ এরা জ্যোতিস্ক এবং
আকাশের তারাদের কাছে চলে যাবো ।
আমাকে ও মনে রেখো পৃথিবীর লোক
আমি খুব বেশী দেশে থাকি নি কখনো ।
আসলে তিনটি মাত্র দেশে আমি থেকেছি,এখন
আমি থাকি বঙ্গদেশে,আমাকেও মনে রেখো বঙ্গদেশ তুমি ।
আমিই তো চিকিৎসক – ফিরে এসো চাকা
– বিনয় মজুমদার
আমিই তো চিকিৎসক, ভ্রান্তিপূর্ণ চিকিৎসায় তার
মৃত্যু হলে কি প্রকার ব্যাহত আড়ষ্ট হয়ে আছি।
আবর্তনকালে সেই শবের সহিত দেখা হয়;
তখন হৃদয়ে এক চিরন্তন রৌদ্র জ্বলে ওঠে।
অথচ শবের সঙ্গে কথা বলা স্বাভাবিক কিনা
ভেবে-ভেবে দিন যায়; চোখাচুখি হলেলজ্জা ভয়ে
দ্রুত অন্য দিকে যাই; কুক্কুপিন্ট ফুলের ভিতরে
জ্বরাক্রান্ত মানুষের মত তাপ; সেই ফল খুঁজি।
এরূপ বিরহ ভালো – ফিরে এসোচাকা
– বিনয় মজুমদার
এরূপ বিরহ ভালো ; কবিতার প্রথম পাঠের
পরবর্তীকাল যদি নিদ্রিতের মতো থাকা যায়,
স্বপ্নাচ্ছন্ন, কাল্পনিক ; দীর্ঘকাল পরে পুনরায়
পাঠের সময় যদি শাশ্বত ফুলের মতো স্মিত,
রূপ, ঘ্রাণ, ঝ’রে পড়ে তাহলে সার্থক সব ব্যথা,
সকল বিরহ, স্বপ্ন ; মদিরার বুদ্বুদের মতো
মৃদু শব্দে সমাচ্ছন্ন, কবিতা, তোমার অপ্রণয়।
হাসির মতন তুমি মিলিয়ে গিয়েছো সিন্ধুপারে।
এখন অপেক্ষা করি, বালিকাকে বিদায়দেবার
বহু পরে পুনরায় দর্শনের অপেক্ষার মতো____
হয়তো সর্বস্ব তার ভ’রে গেছে চমকে চমকে।
অভিভূত প্রত্যাশায় এরূপ বিরহব্যথা ভালো।।
২৯ জুন ১৯৬২ – ফিরে এসো চাকা
– বিনয় মজুমদার
তুমি যেন ফিরে এসে পুনরায় কুণ্ঠিত শিশুকে
করাঘাত ক’রে ক’রে ঘুম পাড়াবার সাধ ক’রে
আড়ালে যেও না ; আমি এত দিনে চিনেছি কেবল
অপার ক্ষমতাময়ী হাত দুটি, ক্ষিপ্র হাত দুটি—
ক্ষণিক নিস্তারলাভে একা একা ব্যর্থ বারিপাত |
কবিতা সমাপ্ত হতে দেবে নাকি? সার্থক চক্রের
আশায় শেষের পংক্তি ভেবে ভেবে নিদ্রা চ’লে গেছে |
কেবলি কবোষ্ণ চিন্তা, রস এসে চাপ দিতে থাকে |
তারা যেন কুসুমের অভ্যন্তরে মধুর ঈর্ষিত
স্থান চায়, মালিকায় গাঁথা হয়ে ঘ্রাণ দিতে চায় |
কবিতা সমাপ্ত হতে দাও, নারী, ক্রমে—ক্রমাগত
ছন্দিত ঘর্ষণে, দ্যাখ, উত্তেজনা শির্ষ লাভ করে,
আমাদের চিন্তাপাত, কসপাত ঘটে, শান্তি নামে |
আড়ালে যেও না যেন, ঘুম পাড়াবার সাধ ক’রে |
২৯ জুন ১৯৬২ – ফিরে এসো চাকা
– বিনয় মজুমদার
কবিতা বুঝিনি আমি ; অন্ধকারে একটি জোনাকি
যত্সামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক |
এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ প’ড়ে আছে—
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট ক’রে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
তারকা, জোনাকি—সব ; লম্বিত গভীরহয়ে গেলে
না-দেখা গহ্বর যেন অন্ধকার হৃদয় অবধি
পথ ক’রে দিতে পারে ; প্রচেষ্টায় প্রচেষ্টায় ; যেন
অমল আয়ত্তাধীন অবশেষে ক’রে দিতে পারে
অধরা জ্যোত্স্নাকে ; তাকে উদগ্রীব মুষ্টিতে ধ’রে নিয়ে
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের, অন্তরের সার পেতে পারি |
এই অজ্ঞানতা এই কবিতায়, রক্তে মিশে আছে
মৃদু লবণের মতো, প্রশান্তির আহ্বানের মতো |
২৭ জুন ১৯৬২ – ফিরে এসো চাকা
– বিনয় মজুমদার
করবী তরুতে সেই আকাঙ্খিত গোলাপ ফোটে নি |
এই শোকে ক্ষিপ্ত আমি ; নাকি ভ্রান্তি হয়েছে কোথাও?
অবশ্য অপর কেউ, মনে হয়, মুগ্ধ হয়েছিল,
সন্ধানপর্বেও দীর্ঘ, নির্নিমেষ জ্যোত্স্না দিয়ে গেছে |
আমার নিদ্রার মাঝে, স্তন্যপান করার মতন
ব্যবহার ক’রে বলেশিহরিত হৃদয়ে জেগেছি |
হায় রে বাসি না ভালো, তবু এও ধন্যসার্থকতা,
এই অভাবিত শান্তি, মূল্যায়ন, ক্ষিপ্ত শোকে ছায়া |
তা না হ’লে আস্বাদিত না হবার বেদনায় মদ,
হৃদয় উন্মাদ হয়, মাংসে করে আশ্রয়-সন্ধান |
অখচ সুদূর এক নারী শুধু মাংস ভোজনের
লোভে কারো কাছে তার চিরন্তন দ্বার খুলেছিলো,
যথাকালে লবণের বিস্বাদ অভাবে ক্লিষ্ট সেও |
এই পরিনাম কেউ চাই না, হে মুগ্ধ প্রীতিধারা,
গলিত আগ্রহে তাই লবণ অর্থাত্ জ্যোত্স্নাকামী |
২৬ অগাষ্ট ১৯৬০ – ফিরে এসোচাকা
– বিনয় মজুমদার
মুকুরে প্রতিফলিত সূর্যালোক স্বল্পকাল হাসে |
শিক্ষায়তনের কাছে হে নিশ্চল, স্নিগ্ধ দেবদারু
জিহ্বার উপরে দ্রব লবণের মত কণা-কণা
কী ছড়ায়, কে ছড়ায় ; শোনো, কী অস্ফুট স্বর, শোনো
‘কোথায়, কোথায় তুমি, কোথায় তোমার ডানা, শ্বেত পক্ষীমাতা,
এই যে এখানে জন্ম, একি সেই জনশ্রুত নীড় না মৃত্তিকা?
নীড় না মৃত্তিকা পূর্ণ এ অস্বচ্ছ মৃত্যুময় হিমে…’
তুমি বৃক্ষ, জ্ঞানহীন, মরণের ক্লিষ্ট সমাচার
জানো না, এখন তবে স্বর শোনো,অবহিতহও |
সুস্থ মৃত্তিকার চেয়ে সমুদ্রেরাকত বেশি বিপদসংকুল
তারো বেশি বিপদের নীলিমায় প্রক্ষালিত বিভিন্ন আকাশ,
এ-সত্য জেনেও তবু আমরা তো সাগরে আকাশে
সঞ্চারিত হ’তে চাই, চিরকাল হ’তে অভিলাষী,
সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভালো লাগে ব’লে |
তবুও কেন যে আজো, হায় হাসি, হায় দেবদারু,
মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়!
৮ মার্চ ১৯৬০ – ফিরে এসো চাকা
– বিনয় মজুমদার
একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত পস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেলো — এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেগনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হ’লো ফল |
বিপন্ন মরাল ওড়ে, অবিরাম পলায়ন করে,
যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নিচে
রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ ;
স্বল্পায়ু বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত পাহাড়ে পাহাড়ে ;
সমস্ত জলীয় গান বাষ্পিভূত হ’য়ে যায়, তবু
এমন সময়ে তুমি, হে সমুদ্রমত্স্য, তুমি…তুমি…
কিংবা, দ্যাখো, ইতস্তত অসুস্থ বৃক্ষেরা
পৃথিবীর পল্লবিত ব্যাপ্ত বনস্থলী
দীর্ঘ-দীর্ঘ ক্লান্তশ্বাসে আলোড়িত করে ;
তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে
চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা |
ভালোবাসা দিতে পারি
বিনয় মজুমদার
ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ’রে যায় –
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
এ আমার অভিজ্ঞতা। পারাবতগুলি জ্যোৎস্নায়
কখনো ওড়ে না; তবু ভালোবাসা দিতে পারি।
শাশ্বত, সহজতম এই দান — শুধু অঙ্কুরের
উদগমে বাধা না দেওয়া, নিষ্পেষিত অনালোকে রেখে
ফ্যাকাশে হলুদবর্ণ না ক’রে শ্যামল হতে দেওয়া।
এতই সহজ, তবু বেদনায় নিজ হাতে রাখি
মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালোবেসে ফেলে ফেলি।
গ্রহণে সক্ষম নও। পারাবত, বৃক্ষচুড়া থেকে
পতন হলেও তুমি আঘাত পাও না, উড়ে যাবে।
প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি
চ’লে যাবে; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় স্তব্ধ হব আমি।
মাঝে-মাঝেই আমি-
বিনয় মজুমদার
মাঝে-মাঝেই আমি হিন্দুগণের ব্যবহারে ক্ষুণ্ণ হয়ে
ভেবেছি ‘খৃস্টান হয়ে যাব কি? খৃস্টান হয়ে যাব কি…’
তখন মনে পড়েছে খৃস্টান যদি হই তাহলে
আমার মৃতুয়র পরে আমাকে পোড়াবে না।
মাটি চাপা দেবে। মাটি চাপা দেওয়া চলবে না।
মরে গেলে আমাকে পোড়াতেই হবে। এইহেতু
আমি খৃস্টান হইনি।
শ্রদ্ধা জানাই
ReplyDeleteআবৃত্তি করার স্পৃহা জাগলো.. .. ভালবাসা কবির প্রতি
ReplyDeleteঅসাধারণ সব কবিতা
ReplyDeleteসুন্দর ছিলো
ReplyDeleteকবিতাগুলো টাইপ করার সময় অনেক ভুল আছে মনে হচ্ছে। যেমন "এর শব্দতাতিবক প্রমাণ আছে"। "অথচ হেতরু,
ReplyDeleteতুমি নিজে নির্বিকার, এই প্রিয় বেদনা বোঝো না।
কে ক্থোয় নিভে গেছে তার গুপ্ত কাহিনী জানি" । আরও কয়েকটি রয়েছে। 'হিবয়া' , 'পস্তাবে' এমন সব।এতে কবিতাগুলো মার খাচ্ছে। একটু দেখবেন অনুগ্রহ করে।
ঠিক বলেছেন।
DeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteআনন্দময় হলাম
ReplyDelete